Monday, January 18, 2016

আসমা বিনতে আবু বকর (রা)। এক মহান মহিলা সাহাবী। পিতাও ছিলেন প্রথম খলিফা এবং খুব মর্যাদাবান এক সাহাবী হযরত আবু বকর (রা)। আসমা ছিলেন চরিত্রের দিক থেকে যেমন সুদৃঢ়, তেমনি সাহসিনী। প্রথম যুগেই যারা ইসলাম কবুল করেছিলেন, হযরত আসমা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময় মাত্র সতের জন নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণের এই সোনালি সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। এই দিক থেকেও তিনি দারুণ সৌভাগ্যবতী। হযরত আসমাকে বলা হতো জাতুন নিতাকাইন। অর্থাৎ দু’টি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী। এটা কেন বলা হতো? কারণ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় আসমা রাসূল (সা) ও তার পিতা আবু বকরের জন্য থলিতে পাথেয় ও মশকে পানি পানি ভরে দিয়েছিলেন। ভরাও শেষ। এবার মুখ দু’টি বাঁধার পালা। কিন্তু কী দিয়ে বাঁধবেন? হাতের কাছে তেমন কিছুই পেলেন না। অবশেষে নিজের কোমর বন্ধনী খুলে দু’টুকরো করে তাই দিয়েই পাত্র দু’টির মুখ শক্ত করে বেঁধে দিলেন। আসমার এই বুদ্ধিদীপ্ত কাজটি দেখলেন রাসূল (সা)। দেখলেন আর হাসলেন। দয়ার নবীজীর বুকটা ভরে গেল আনন্দে। তিনি দুয়া করলেন আসমার জন্য : ‘আল্লাহ পাক যেন এর বিনিময়ে জান্নাতে তাকে দু’টি নিতাক দান করেন।’ আবু বকরের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে ছিল না কোনো গর্ব বা অহঙ্কার। ছিল না এতটুকু দেমাগ। বিয়ের পর, দরিদ্র স্বামীর ঘরে গেলেন আসমা। দরিদ্র মানে, হত দরিদ্র। একেবারেই নিঃস্ব বলা যায়। স্বামীর একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ছিল না ফুট-ফরমায়েশ খাটার মতো কোনো চাকর-বাকরও। তা না থাক। এসব নিয়ে আসমার মনে কোনো কষ্ট বা দুঃখও ছিল না। ছিল না বুকের মধ্যে সামান্যতম বেদনার মেঘ। বরং তিনি হাসি মুখে সবই মেনে নিতেন। স্বামীসেবা করতেন, ঘোড়ার জন্য ভুসি পিষতেন, ঘোড়াটিকে দেখাশুনা করতেন এবং সংসারের যাবতীয় কাজ নিজ হাতে করতেন। পরে অবশ্য কেটে গিয়েছিল তাদের কষ্টের কাল। আল্লাহর রহমত আর নবীজীর আন্তরিক দোয়ার বরকতে এক সময় তারা অনেক ধন-সম্পদের মালিকও হয়েছিলেন। হিজরাতের সময় ঘনিয়ে এল। এই সময়ে আসমা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। পেটে তার অনাগত বাচ্চা। কষ্টের কথা না ভেবেই তিনি হিজরাতের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লেন। মক্কা থেকে মদীনা। কম দূরের পথ নয়। কম কষ্টের পথ নয়। তবুও আসমা ভেঙে পড়লেন না। আল্লাহর সন্তষ্টিই যে ছিল তার একমাত্র কাম্য! কুবা পৌঁছার পরই আসমা প্রসব বেদনায় কাতর হয়ে পড়লেন। ভূমিষ্ঠ হলো এক পুত্র সন্তান। নাম রাখলেন আবদুল্লাহ। মদীনার মুহাজিরদের মধ্যে প্রথম সন্তান বয়ে গেল এক আনন্দের জোয়ার। তাকবির ধ্বনিতে তারা ফেটে পড়লেন উল্লাসে। সদ্যভূমিষ্ঠ আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে আসমা চললেন রাসূলের (সা) কাছে। আবদুল্লাহকে দেখে রাসূল (সা) কী যে খুশি হলেন! ছেলেটিকে আসমা তুলে দিলেন রাসূলের (সা) কোলে। রাসূল দেরি না করেই নিজের মুখের কিছু থু থু নিয়ে আবদুল্লাহর মুখে দিলেন এবং তার জন্য প্রাণ খুলে দুয়া করলেন আল্লাহর দরবারে। আবদুল্লাহর মুখে দুনিয়ার অন্য কোনো খাদ্যবস্তু প্রবেশের আগেই রাসূলের পবিত্র থু থু প্রবেশ করেছিল। এই দিক থেকেও আবদুল্লাহ ছিলেন সৌভাগ্যবান। পরে তিনিও তো হয়েছিলেন একজন দুঃসাহসী মুজাহিদ। ইসলামের জন্য আসমার অবদান ছিল অসামান্য। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সঙ্কটকালে তিনি যে ধরনের বুদ্ধিমত্তা আর সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। ইতিহাসেও তা এক বিরল দৃষ্টান্ত। রাসূল (সা) আবু বকরকে (রা) নিয়ে হিজরত করতে গেলেন। খবরটি মক্কায় ছড়িয়ে যাবার সাথে সাথে ক্ষেপে উঠলো নরাধম আবু জেহেল। মুহূর্তেই সে ছুটে গেল আবু বকরের (রা) বাড়িতে। আসমাকে (রা) সামনে পেয়ে সে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো, তোমার আব্বা কোথায়? আসমা দৃঢ়তার সাথে বললেন, না-বলবো না। ব্যাস্! সাথে সাথে পাপিষ্ট আবু জেহেল জোরে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো আসমার কচি গালে। এমন জোরে থাপ্পড়টি সে মেরেছিল যে, ছিটকে পড়ে গেল আসমার কানের দুল। কী ভয়ানক দৃশ্য! হিজরাতের সময় রাসূল (সা) ও পিতা আবু বকর (রা) আশ্রয় নিয়েছিলেন সাওর পর্বতের নির্জন ও বিপদসঙ্কুল গুহায়। এই সময়ে, রাতের অন্ধকারে আসমা তাঁদের জন্য খাবার ও পানীয় বয়ে নিয়ে যেতেন সেখানে একাকী। চুপে চুপে। তার হৃদয়ে কোনো ভয় ছিল না, ছিল না কোনো শঙ্কার লেশমাত্র। সময় গড়িয়ে গেছে অনেক। কালের পিঠে পড়ে আছে বহুক্ষত-বিক্ষত স্মৃতিবাহী চিহ্ন। আসমার বয়সও সেই সাথে বেড়ে গেছে। বুকে ধারণ করে আছেন বহুস্মৃতিবাহী ঘটনা। রাসূল (সা) নেই। নেই পিতা আবু বকরও। সময়ের ব্যবধানে একে একে সবাই চলে গেছেন। হযরত আলীর খিলাফতকালও শেষ। ইন্তেকাল করেছেন উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়াও। তার মৃত্যুর পর হিজাজ, মিসর, ইরাক ও খুরাসানসহ সিরিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলের লোক আসমার পুত্র আবদুল্লাহকে খলিফা বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এতে ক্ষেপে উঠলো উমাইয়া রাজবংশ। আবদুল্লাহকে দমনের জন্য তারা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নেতৃত্বে এক বিরাট শক্তিশালী বাহিনী পাঠালো। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল দুই পক্ষের মধ্যে। এক সময় আবদুল্লাহর বাহিনীর অনেকেই দলত্যাগ করে চলে গেলেন বিজয়ের সম্ভাবনা না দেখে। বাকিদের নিয়ে আবদুল্লাহ আশ্রয় নিলেন কাবার হারাম শরীফে। সামনেই চূড়ান্ত সংঘর্ষ। আবদুল্লাহ এই সময়ে ছুটে গেলেন প্রাণপ্রিয় মায়ের কাছে। আসমা তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। চোখেও দেখতে পান না। তবুও আবদুল্লাহ মায়ের সাথে শেষ পরামর্শের জন্য ছুটে এসেছেন। তাকে দেখেই আসমা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার! তুমি এখন এখানে কেন? হাজ্জাজ বাহিনীরা হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করছে, আর তুমি ছুটে এসেছো এখানে! আবদুল্লাহ বললেন, আপনার সাথে পরামর্শের জন্য এসেছি। এখন আমি কী করবো, বলে দিন আম্মা! পরামর্শ? কোন্ বিষয়ে? জিজ্ঞেস করলেন আসমা। আবদুল্লাহ বললেন, হাজ্জাজের ভয়ে অথবা তার প্রলোভনে আমার দলের অনেকেই চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। এমনকি আমার সন্তান ও আমার পরিবারের লোকেরাও পরিত্যাগ করেছে আমাকে। এখন আমার সাথে অল্প কিছু লোক আছে। তারা যত সাহসীই হোক না কেন, হাজ্জাজের শক্তিশালী বাহিনীর সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারবেন না। এদিকে উমাইয়া প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানকে খলিফা বলে মেনে নিই, যদি তার হাতে বাইয়াত হই তাহলে সে আমাকে অনেক সম্পদ ও পার্থিব সুখ ভোগের ব্যবস্থা করবে। আমি যা চাইবো, সে তাই দেবে। এখন আপনিই বলুন আম্মা, আমি কী করবো? হযরত আসমা ধৈর্যের সাথে শুনলেন পুত্র আবদুল্লাহর কথা। তারপর দৃঢ়তার সাথে বললেন, ব্যাপারটি একান্তই আমার নিজস্ব। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জান। যদি তোমার বিশ্বাস থাকে যে, তুমি সত্যের পথে আছ এবং মানুষকে হকের পথে আহবান করছো, তাহলে তোমার পতাকাতলে থেকে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন, তুমিও তাদের মতো অটল থাকো। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগের লোভের প্রত্যাশী হও, তাহলে বলবো-তুমি একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার সাথীদেরকে ধ্বংস করেছো। আবদুল্লাহ বললেন, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে নিশ্চিত আজ আমি মারা যাব। আসমা জবাবে বললেন, হাজ্জাজের কাছে তুমি স্বেচ্ছায় আত্মসর্মúণ করবে এবং তার দলের ছেলেরা তোমার মস্তক নিয়ে খেলা করবে। তার চেয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়াই উত্তম। আবদুল্লাহ বললেন, আম্মা! আমি মরতে ভয় পাচ্ছি না মোটেও। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমার হাত-পা কেটে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে! পুত্রের কথা শুনে আসমার কণ্ঠে বেজে উঠলো আবারো সাহস ও দৃঢ়তার বজ্রধ্বনি : নিহত হবার পর মানুষের ভয়ের আর কিছুই নেই। কারণ, জবেহ করা ছাগলের চামড়া তোলার সময় সে আদৌ কষ্ট পায় না। মায়ের কথায় বেড়ে গেল আবদুল্লাহর মনের জোর। শাহাদাতের স্বপ্নে তখন তিনি বিভোর। তিনি দ্রুত চললেন যুদ্ধের দিকে। আসমা বললেন, তুমি আমার কাছে একটু এসো। শেষ বারের মত তোমাকে একটু স্পর্শ করি এবং তোমার শরীরের গন্ধ নিই। আবদুল্লাহ আম্মার কাছে এগিয়ে এলে তার শরীরে হাত রেখে আদর করেছিলেন। মায়ের স্নেহের পরশে শিউরে উঠলো আবদুল্লাহর শরীর। একটু পরে আসমা বললেন, একি! তুমি এসব কী পরেছ? আবদুল্লাহ বললেন, আমার বর্ম। আসমা প্রশান্ত মুখে হেসে বললেন, বৎস! যারা শাহাদাতের পিয়াসী হয়, এটা তাদের পোশাক নয়। তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহসিকতা আর আক্রমণের পক্ষে উচিত কাজ হবে এমনটিই। তা ছাড়া এটা হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার পক্ষেও সহজতর। বরং এর পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেয়া হলেও তোমার সতর থাকবে অপ্রকাশিত। মায়ের নির্দেশ মতো আবদুল্লাহ বর্ম খুলে পাজামা পরলেন। তারপর হারাম শরীফের দিকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য পা বাড়াবার আগে বললেন, আম্মা, আমার জন্য একটু দুয়া করে দিন। বয়োবৃদ্ধ, অন্ধ আসমা সাথে সাথে হাত উঠালেন আল্লাহর দরবারে। বললেন : ‘হে আল্লাহ! রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন তার জেগে জেগে দীর্ঘ ইবাদাত ও উচ্চকণ্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার ওপর রহম করুণ। হে আল্লাহ রোজা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধাহ্ন্যকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের জন্য তার প্রতি আপনি করুণা বর্ষণ করুন। হে আল্লাহ, আমি তাকে আপনারই কাছে সোপর্দ করছি, তার জন্য আপনি যে ফয়সালা করবেন তাতেই আমি রাজি। এর বিনিময়ে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করুন।’ মায়ের দুয়া নিয়ে আবদুল্লাহ চলে গেলেন যুদ্ধে। এবং শহীদ হলেন। আবদুল্লাহকে শহীদ করার পর হাজ্জাজ তার লাশটিকে শূলিতে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তার মা আসমা এলেন ছেলের পাশে। শূলে লটকানো ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্ত ও স্থির কণ্ঠে বললেন, ‘এ সওয়ারির এখনো ঘোড়া থেকে নামার সময় হলো না!’ হাজ্জাজ এগিয়ে এলো আসমার কাছে। হেসে বললো, বলুনতো আপনার ছেলের সাথে কেমন ব্যবহার করেছি? দৃঢ়তার সাথে আসমা, একজন সদ্যশহীদের মা বললেন, ‘তুমি তার দুনিয়া নষ্ট করেছো। আর সে তোমার পরকাল নষ্ট করেছে। তুমি তাকে ‘যাতুন নিতাকাইন’ বলে নাকি ঠাট্টা করেছো। আল্লাহর কসম, আমিই ‘যাতুন নিতাকাইন’। একটি নিতাক নিয়ে আমি রাসূল (সা) ও আমার পিতা আবু বকরের খাবার বেঁধেছি। আর একটি নিতাক আমার কোমড়েই আছে। মনে রেখ, রাসূলের (সা) কাছ থেকে শুনেছি, সাকিফ বংশে একজন মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং একজন জালিম পয়দা হবে। মিথ্যাবাদীকে তো আগেই দেখেছি। আর সেই জালিমটা হচ্ছো তুমি।’ এই হচ্ছেন দুঃসাহসিনী এক মা-হযরত আসমা (রা)। শহীদ পুত্রের বীভৎস দৃশ্যের সামনেও যিনি সমান শান্ত, শান্ত এবং স্থির এক সাওর পর্বত।